শুক্রবার ১১ এপ্রিল ২০২৫

সম্পূর্ণ খবর

Valentines Day 2025: what is the significance of valentines day in Kolkata

উত্তর সম্পাদকীয় | বুড়ো কলকাতা, ভ্যালেন্টাইনস ডে এবং ভালবাসার জন্য ভালবাসা

Akash Debnath | ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ১৩ : ৫১Akash Debnath


আকাশ দেবনাথ: কলকাতা শহরে প্রতি বছর এক আশ্চর্য বসন্ত আসে। গত বারের থেকে আরও একটু উলোঝুলো, দীনহীন, অভাজন, রুক্ষ, শ্রীহীন এক বসন্ত। যেন নিজেরই নিজের যৌবন অটুট রাখার ক্ষমতাটুকু পর্যন্ত নেই। তবু আসে নিয়ম করে। নিম্ন মধ্যবিত্তের ভালবাসার মতো। দরিদ্র তবু দিৎসু। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, যদি একবার অন্তত ফিরে তাকায় প্রেম। 

কলকাতা সমরখন্দ নয়, বোখারাও নয়, তবু প্রতি বসন্তে নিজেকে বিলিয়ে দিতে উৎসুক হয়ে ওঠে। কিছুটা সাবির আলির মতো। সাবির ভ্যালেন্টাইনকে চেনে না। কিন্তু অসুস্থ কন্যার চিকিৎসায় মুর্শিদাবাদ থেকে মেডিক্যাল কলেজে এসে পড়ে থাকা স্ত্রী আমিনার জন্য খবরের কাগজে মুড়ে ঘুগনী-পরোটা নিয়ে আসে। নিজের হাতে খাইয়ে দেয়। সম্ভবত বসন্তের দোষেই রুগ্ন আমিনার কোটরাগত ধূসর চোখ হঠাৎ করে এক পলকের জন্য অবিশ্বাস্য নতুন লাগে। এ কাকে দেখল সাবির? একেই মুরুব্বিরা সমা বলে না তো! ভাবতে ভাবতে আমিনাকে প্রথম বার দেখার কথা মনে পড়ে যায় সাবিরের।

পরোটাটা বানিয়েছে বাবলু। বাবলু যাদব। বাড়ি বিহারে। ১৪ বছর বয়সে যখন প্রথম কলকাতায় আসে তখন কোলে মার্কেটে মুটেগিরি করত। পয়সা জমিয়ে এখন পরোটার দোকান খুলেছে ফুটপাথে। রোজগারপাতি মন্দ না। আগে একহাতে আয় করে অন্য হাতে উড়িয়ে দিত। এখন সঞ্চয় করতে শিখেছে। সোনালী শিখিয়েছে। সোনালী বাবলুর খুব যত্ন করে। বাবলু জানে সোনালী তার সঙ্গে ঘর করতে চায়। কিন্তু সোনাগাছির বেশ্যাকে যে বাড়ির লোক বউ বলে মেনে নেবে না, সেটা ভাল করে জানে বাবলু। তাই দিন রাত খাটছে আজকাল। আবারও বসন্তের দোষেই হয়তো, বাবলু সিদ্ধান্ত নিয়েছে টাকা জমিয়ে সোনালীকে নিয়ে পালাবে। দু’জনে মিলে টাকা জমাচ্ছে ব্যাঙ্কে।

ওই ব্যাঙ্কেই কাজ করে অনামিকা। ম্যানেজার। যে ক্যাপিটালিজমের বিরুদ্ধে স্লোগান দিত কলেজবেলায়, সেই ক্যাপিটালিজমের জোরেই আজকে দিব্য বুর্জোয়া জীবন কাটাচ্ছে। ভেবে রেখেছে এই ভ্যালেন্টাইনস ডে-তে রিয়াকে প্রোপোজ করবে। কিন্তু রিয়া মানবে কি? যে ধর্ম মানে না, পদবি মানে না, সমাজ মানে না, বিত্তকে থুতু দেয়, ডোমেদের সঙ্গে বসে মাঝরাতে বিড়ি ফোঁকে। এমন মেয়ে তাঁকে চাইবে কেন?

একবার অনামিকা জিজ্ঞেস করেছিল রিয়াকে, মাঝরাতে একা একা রাস্তায় ঘুরতে ভয় লাগে না? রিয়া খিস্তি দিয়ে বলেছিল, “বাপ মার পরিচয় জানি না, ফুটপাথে শুতাম। ১১ বছর বয়সে এগারো জন মিলে ধর্ষণ করেছিল। তার আবার ভয়।” বলে হেসে উঠেছিল হাহা করে।

অনামিকার তবু ভয় লাগে। কারণ কলকাতা নিজের চরিত্র বদলাচ্ছে। মুম্বাই, দিল্লি কিংবা ঢাকার মতো। এতো প্রবল হিংস্রতা তো কবেই ছেড়ে দিয়েছিল কলকাতা। তবে কি পুরোনো অসুখ ফিরে আসছে আবার? ধর্মের বিকার, বিকারের ধর্ম- অনামিকার ভয় করে নাস্তিক রিয়াকে নিয়ে।

রিয়া ধর্মকে পচা গলা সভ্যতার গোপনাঙ্গে যৌন ক্ষতের মতো দেখে। নাস্তিক বলেই? নাকি এমনই স্বরূপ তাই? দ্বেষ উত্থিত হচ্ছে ক্রমাগত মন্থনে। নীল হয়ে যাচ্ছে দেশের একের পর এক প্রাচীন শহর। অথচ এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। “কথা ছিল এ দেশ অনার্যের হবে, ধর্ম হবে ফসলের সুষম বন্টন”। স্বপ্ন ভাঙতে ভাঙতে তাসের সে দেশ রক্ষার ভার নিয়ে তিন শতকের জরাজীর্ণ দেহে আজ একা দাঁড়িয়ে কলকাতা। কিন্তু কত দিন? কলকাতার শরীরে শরীরে বার্ধক্য, ক্ষয়। সময় হয়তো বেশি বাকি নেই। তবু যেটুকু আছে তাতেই এই প্রেমের দিনে নীলের থেকে বসন্তের সবুজ আজও বেশি এ শহরে। কে ভ্যালেন্টাইন? অর্ধেক কলকাতা চেনেই না। শুধু জানে সে প্রেমের দিন আনে। ব্যাস এটুকুই, এটুকুই চাই কলকাতার। অবিরাম ঘটে চললে বীভৎসতাও মানুষের অভ্যাস হয়ে যায়। দিনের পর দিন আবর্জনায় ঘেরা জায়গায় থাকলে যেমন আর তার গন্ধে বিবমিষা জাগে না, কিঞ্চিৎ তেমনই। মানুষের হাতে মানুষের রক্ত দেখতে দেখতে সমাজও তাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে শিখে যায়। কলকাতাও শিখছে। অনবরত হিংসা, ক্রোধ, রক্তপিপাসা, অপর করতে পারার মন্ত্র। তবু সেই সংবর্ত প্রক্রিয়ায় একটা দিনের বিরতির মতো প্রতি বসন্তে এই একটা দিন আসে। অবগাহন হয়ে। যেন ভাগীরথীর জলে পুণ্যস্নান করে নিষ্কলঙ্ক হয় কলকাতা।

এই জীবনে কেউ কি কারও বিশ্বস্ততা পেয়েছে? পেতেও পারে। হয়তো এমনিই কোনও এক বসন্তের দিনে মথুরার রাজা বৃন্দাবনের গোয়ালিনীর কাছে নতজানু হয়। পরকে আপন করে জানে। নিরলংকার, নিরাভরণ বেশে সুদূর মরুদেশে বকরি চড়ায়, সিদ্ধার্থ বেশে চেয়ে দেখে জরা, ব্যাধি, মৃত্যু কিংবা তারও ঊর্ধ্বে বেঁচে থাকা। ভালবাসায় বেঁচে থাকা?

কলকাতার সহ্য শক্তি কম নয়। যে শহরের নামে একটা আস্ত দাঙ্গার নাম রাখা হয়। অথচ তার পরেও কোটি কোটি লোকের জন্ম, মৃত্যু, বেঁচে থাকা, মরে যাওয়া এবং ভালবাসা বইতে বইতে সে শহর শ্বাস তোলে, তবু মরণশ্বাস তোলে না তাকে দুর্বল বলা হবে কোন সাহসে? হোক সে ধুঁকতে ধুঁকতে বেঁচে থাকা, হোক সে রৌরবযাপন। তবু তো আজও এ শহরে বসন্ত আসে। বুদ্ধের করুণা মুদ্রার মতো, এক বিন্দু স্পর্শের মতো। তাই বিষাদের বিপ্রতীপে এই একটা দিন ভালবাসার জন্য বরাদ্দ হোক। ভালবাসুক সাবির-আমিনা, বাবলু-সোনালী, অনামিকা-রিয়া। ভালবাসুক কলকাতা, কলকাতার হিন্দু, কলকাতার মুসলমান, কলকাতার বিহারী, কলকাতার মুটে, মজুর, কোটিপতি, বেশ্যা, ছোটলোক, বড়লোক যাকে খুশি। ভালবাসুক। কলকাতার বুড়ো, কলকাতার নবজাতক, কলকাতার পকেটমার, কলকাতার সরকারি কর্মচারী ভালবাসুক, ভালবাসুক।


ValentinesDay2025valentinesdayinKolkata

নানান খবর

আইপিএল লাইভ স্কোর

সোশ্যাল মিডিয়া